Pages

Saturday, July 28, 2007


- Bangladesh - Amar Desh Online

- Bangladesh - Amar Desh Online

Tuesday, July 10, 2007

ইরাক যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ের উপর লেখা একটি গল্প

কারবালার সেই মেয়েটি
সারওয়ার চৌধুরী

-সালাম।
-ওয়া আলাইকুম সালাম।
-কেমন আছো?
-ভাল, হামদুলিললাহ।
-তোমার দোকানটি ছোট হলেও বেশ চমৎকার সাজিয়েছ। আমাকে একটা পারফিউম স্প্রে দাও।
-অবশ্যই অবশ্যই। পুরুষ না মেয়েলোকের?
-নিশ্চই মেয়েলোকের, আমি কি পুরুষ? আমাকে কি তোমার পুরুষ বলে মনে হয় তোমার?
-না মানে স্বামী বাবা ভাই বন্ধু ওদের কারো জন্য তো নিতে পারো।
-না না আমাকে একটা আতর দিয়ে দাও ফ্রি।
-সেটা কি করে সম্ভব?
-তুমি দিলেই তো সম্ভব হয়ে যাবে।
-কিন্তু আমি তো এগুলো পয়সা দিয়ে কিনেছি বিক্রি করার জন্য।
-একটা আমাকে দিয়ে দাও আললাহর ওয়াস্তে, তোমার খায়ের বরকত হবে। আমি মিসকিন।
-তোমাকে তো দেখতে মিসকিন বলে মনে হয়না। তুমি সম্ভবত আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছো।
-সত্যি বলছি, আমি ফকির, ভিা করি।-তুমি জাননা এদেশে ভিা করা মমনু(নিষেধ)। সিআইডি পেলে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে জেলে।
-জানি, তবু লুকিয়ে করি, করা প্রয়োজন তাই।
-তোমার স্বামী নেই?
-না । মা আছেন, এক বোন আছে। একমাত্র ভাই ও বাবাকে আমেরিকান সৈন্যরা মেরে ফেলেছে বাগদাদে। এক বছর হয়ে গেল, এখানে, এই কাতারে, এই দোহাতে, এসেছি বোনের কাছে। মাও ছিলেন, ছ’ মাস থাকার পর দেশে ফিরে গেছেন বাড়ীটা ধরে রাখার জন্য । এখানে বোনের জামাইটার আয় কম। কোন মতে এখানে দশ বছর ধরে আছে। বোনের তিনটা বাচ্ছা আছে। শাশুড়ী ওর সাথেই থাকে। বোনের জামাইয়ের বেতনের টাকায় কোনমতে মাস চলে যায়। আমি এখন বোঝা হয়ে আছি বোনের ঘরে।
-ইরাকের কোথায় তোমাদের বাড়ী?
-কারবালা শহর থেকে দুই কিলোমিটার বাইরে, পশ্চিমের দিকে। আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাই। তুমি তো হিন্দের বড়লোক। আমার ইতিকথা শুনে তোমার ফায়দা নাই। আমিও কেন যে কিছু কথা বলেই ফেললাম।
-না আমি হিন্দি নই, বাংলাদেশী।
-ও আচ্ছা বাঙ্গালী?
-হাঁ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, তাই বাঙ্গালী। কিন্তু আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।
-বাংলাদেশে কি আতর-পারফিউমে ভরপুর? আমি দেখলাম, বেশীরভাগ আতরের দোকান বাঙ্গালীদের।
-বাঙ্গালীরা এই জিনিসের ব্যবসায়ে আগ্রহী। তা তুমি লেখাপড়া কতটুকু করেছ?
-চার কাশ মাত্র । পড়ালেখা বেশী থাকলে তো এখানে একটা চাকরী পেয়ে যেতাম। ঠিক আছে, এবার যাই, তুমি তো আতর দিচ্ছনা। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভি েকরে অন্তত একশ রিয়াল যোগাড় করতে হবে। একশ রিয়াল হলে পঞ্চাশ রিয়াল বোনকে দেই আর বাকী পঞ্চাশ আমি জমা রাখি।
-কেন জমা করো?-কিছু মায়ের জন্য পাঠাই, আর কিছু নিজের ভবিষ্যতের জন্য।-তোমার বোনকে বলনা কেন তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে? তুমি তো মাশাললা সুন্দরী, বয়সও তো বেশী নয়, আঠারো/বিশ হবে হয়তো।-না না সতেরো বছর। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমাকে সুন্দরী বলেছো। খোদা আমার সমস্ত শরীরটাকে সুন্দর করে বানিয়েছেন সত্য কিন্তু মিসকিন, বিদ্যাবুদ্ধিও নাই। এই সুন্দরের কি দাম?
-আরে তোমার চোখে পানি এসে গেছে দেখছি! দুঃখ করো না। জীবনটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করো। তোমার নাম কী?
-লিসা। আমি মুসলিম নই,মসিহী, খৃষ্টান আরব।
তুমি?-আমি মুসলিম। আচ্ছা তো বলো দেখি, তোমরা খৃষ্টান, তবু আমেরিকান সৈন্যরা তোমার বাবা ও ভাইকে মেরে ফেললো? ওরা তো খৃষ্টান।-আরে ওদের ধর্মটর্ম কিছু নাই। ওরা এসেছে ইরাকের তেল লুট করতে। আমার বাবা ও ভাই গেরিলাদের সাহায্য করতে যেয়ে ওদের হাতে ধরা পড়ে গেল। বিশ্বাস করো, আমার বাবা অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। সাদ্দামকেও সমর্থন করতেন না। আমাদের আশেপাশের মুসলমানরা আমার বাবাকে খুবই ভালবাসতো। আরো একটি সত্য কথা তোমাকে বলবো?-বলো। আমি সত্য কথা পছন্দ করি। তুমি সত্য কথা বলো, আমি তোমাকে উপহার দেবো।
-আমার বাবাকে মেরে ফেলার তিনমাস আগে,,,,,,,,,তুমি আবার নারাজ হয়ে যাবে না তো?
-না না তুমি বলো।
-তিনমাস আগে বাগদাদের এক যুবকের সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। যুবকটি প্রথম মাসখানেক আমাকে খুব ভালবেসেছে। আমেরিকান শিবিরে কি যেনো একটা কাজ করতো। আমাকে মানা করেছিলো বাবাকে না বলতে। আমি বাবাকে বলিনি। কিন্তু বাবা ও ভাইকে মেরে ফেলার পর দেখি সে বদলে যেতে থাকে। বাবার মউতের একমাস বাদে সে আমেরিকা চলে যায় আমাকে ছেড়ে। একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে সে আর আমেরিকা থেকে ফিরে আসবেনা। আমি যেনো অন্য কাউকে বিয়ে করি, তা-ও জানালো।
-ঐ যুবকের মা বাবা আত্মীয়-স্বজন কী বললো?
-ওর মা বাবা বললো, ছেলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে, আমরা কি আর করবো, চলে যাও তোমার মায়ের কাছে। সন্তানাদী যখন হয়নি, তখন আর চিন্তা কিসের? অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলো।
-তুমি করে সংসারী হতে চাও?-হ্যাঁ চাই বটে। কিন্তু এক বছর হয়ে গেলো কোন সুজন পুরুষের সন্ধান পাইনি। দু একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলো আমার বোন। ওরা ভাবেসাবে, বুঝা গেছে, আমার শরীরটাকেই উপভোগ করতে চায়।
-তোমার বয়সী অনেক মেয়েই তো এই শহরে, প্রতিরাতে অনেক পুরুষের সঙ্গে শুয়ে পয়সা কামায়। তুমি ঐ রকম করলে অসুবিধা কি? যৌবনের চাহিদাও মিটলো পয়সা কামাইও হলো।-অনেকদিন ভেবেছি ও রকম হয়ে যাই, বোনটাও রাজী আছে, মন বারবার বলালো-ব্যাপারটা অত্যন্ত নোংরা, অনেক পুরুষের সঙ্গে প্রতিরাতে -------- না না না আমি পারবোনা। চব্বিশ ঘণ্ঠা ঐ কামের ধান্ধায় থাকা কোন মানুষের কাম না। হায়ওয়ান হয়ে যেতে হবে। আমি একটা পরিচ্ছন্ন জীবন চাই। কোন মুসলিম ভালো যুবক চাইলে, আমি মুসলিম হয়ে ওকে বিয়ে করতে রাজী আছি।-তুমি খুব ভালো মেয়ে।
-ধন্যবাদ তোমাকে। আচ্ছা আমি আজ উঠি। তোমার দোকানে এখন কাস্টমার আসবে। এভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলতে দেখে কে কি ভেবে বসে আবার।
-আরে কে কি ভাববে -আমি ওসবের তোয়াক্কা করিনা। তুমি কাল এসো, তোমার সঙ্গে কথা বলবো।তুমিও তো দেখছি খুব ভালো মানুষ। এতো ভালো মানুষ এই প্রথম দেখলাম।
-তোমাকে ধন্যবাদ। এই পারফিউমটা নিয়ে যাও, এটা তোমাকে হাদিয়া দিলাম।
-তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।
-তোমাকেও ধন্যবাদ। চোখের পানি মুছে ফেলো। চোখের পানিটা মানুষকে ধোকায় ফেলে।
-তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার মনটা অনেক হালকা হলো।
-ধন্যবাদ, তুমি দীর্ঘজীবি হও, তোমার অনেক মঙ্গল হোক।
-ধন্যবাদ, খোদা হাফেজ।
দুই
পরদিন দুপুর বেলা বারটা। দোহা শহরের চৌরাস্তার মোড়। মানুষের জমায়েত। কিছু একটা হয়েছে। এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাই। দেখি, এক্সিডেন্ট। একটি মার্সিডিজ কার একজন মেয়েলোককে রাস্তা পার হওয়ার সময় মেরে দিয়েছে। মেয়েটি রাস্তায় পড়ে আছে। কিছুনের মধ্যে পুলিশের গাড়ী এসে যাবে। তার আগে গিয়ে দেখে নেই। ইয়া আললাহ! এতো দেখছি লিসা, কারবালার সেই মেয়েটি! চোখ খোলা। কটমট করে আকাশের দিখে তাকিয়ে আছে। সমস্ত শরীরে কোন স্পন্দন নেই। এ্যাম্বুল্যানস এলো। ফিলিপিনো ডাক্তারটি চেক আপ করে বললো, ’ওহ গড! শী ইজ এ্যা বিউটিফুল গার্ল- শী হেজ গান, শী হেজ লেফট দিস ওয়ার্লড!!
সমাপ্ত

Monday, July 9, 2007

আমার দ্বিতীয় বইয়ের প্রচ্ছদ। ২০০৬ সালের বাংলা একাডেমির বইমেলায় প্রকাশিত।
প্রকাশক-শুদ্ধস্বর প্রকাশনী।

Friday, July 6, 2007

আমার একটি গল্প

মা এবং মায়ের মায়া
এক কম একশ’ বছর আগে লেখা মাঙ্মি গোর্কি’র ‘মা’ উপন্যাসটি সে গতরাতে দ্বিতীয়বার পড়েছে। প্রথম পড়েছিলো দশ বছর আগে, দেশে থাকতে। এখন বিদেশে, আবুধাবিতে। একটানা ছয় বছর হয়ে গেলো, দেশে আসতে পারে নি পেশাগত জটিলতার কারণে। এই ছয়টা বছরে সে অন্তত কয়েক হাজারবার মাতৃমায়ার আবেগে আপ্লুত হয়েছে। তার নাম টিপু। ‘মা’ উপন্যাসটি যে-রাজনৈতিক দর্শনের ছায়ায় রচিত, সেই দর্শনের পক্ষে-বিপক্ষে হয়তো অনেক কথা বলা যেতে পারে। তবে ওটাতে বিপ্লবী মা ও ছেলের মাধ্যমে যে-মানবিক আবেদনের পরিস্ফুটন করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে এক চিরায়ত শিল্পকর্ম বলে সে মনে করে। গোর্কি একজন বড়ো মাপের ভাষাশিল্পী বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। গতরাতে পড়া উপন্যাসটির বিভিন্ন দিক নিয়ে সে তার কর্মস্থল, নিজের দোকানে বসে ভাবছিলো সকাল দশটার দিকে। এই সময়, তার দোকানের সামনেই এক আরবি মা তিন বছরের ছেলেটিকে ছেলেটির দুরন্তপনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বলছেন,‘ ইনতা ক্বলবি, ইনতা হাবিবি, ইনতা হায়াতি, ইয়া বাবা, লাত ইজায়ালনি!’ অর্থাৎ, তুমি আমার জান, তুমি আমার প্রিয়, তুমি আমার প্রাণ, হে বাপজান আমার, আমাকে জ্বালিও না! কথাটা বলেছেন মা মায়াবি কন্ঠে, স্নেহময় আবেশ ছড়িয়ে, দু’হাতে ছেলেটির গালে সম্মোহনের পরশ দিতে দিতে। এই দৃশ্যটা দোকানদার,মানে পারফিউম ব্যবসায়ী টিপু, খুব মনোযোগে দেখতে দেখতে তার দু’-চোখ ভরে ওঠে পানিতে। নিজের মায়ের কথা মনে পড়েছে। তার মাকে সেও তো অনেক জ্বালিয়েছে ছোটবেলায়। কিন্তু যদ্দূর স্মরণ হয়, মা তাকে একবারও মারেন নি। ইয়াদ আছে, পাঁচছৈয়বছর বয়সকালে দুষ্টুমি না করার জন্য মা কাছে ডেকে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন,‘লক্ষ্মী বাবা আমার, অমনটি করিস না, ওরকম শয়তানি করলে আল্লাহ নারাজ হবেন।’ মা মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বললে সেটা মগজের ভেতরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসে যায়। এই টিপু এখন এক তেত্রিশ বছরের শিশু! কেন শিশু বলবো না? পঞ্চাশ বছরের হলেও যে-মুহূর্তে একটি পুত্র তার মায়ের কথা ইয়াদ করে কান্না আক্রান্ত হয়, সে কি ঐ মুহূর্তের জন্য শিশু হয়ে গেল না? আর একটি মানুষের সাথে তার শৈশব কি সারাটা জীবনভর থাকে না? থাকে। স্মৃতির প্রকোষ্ঠে উজ্জ্বল হয়েই থাকে। দেখুন, কী আশ্চর্য! মায়ের মনের কারিশমা! তেত্রিশ বছরের এক পূর্ণ মানুষ, শিক্ষিত, চৌকস, যে কিনা সমস্ত দিনরাত অগণন বিষয়ে মাথা ঘামায়, তর্ক-বিতর্ক করে; অত্যন্ত হিসেবি চালে লেনদেন করে; কিছু লোক তাকে কঠোর-কঠিন-জবরদস্ত লোক বলে জানে। এই লোকটিকে তার মায়ের মমতামাখা স্মৃতি এসে এতোটাই কোমল বানিয়েছে, যার কারণে সে এক মা হারা শিশুর আর্তি বুকে নিয়ে কেঁদে ওঠে। বারবার, প্রায় প্রতিদিন, কখনো সকালে, কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়। কখনো গভীর রাতে স্বপ্নের ঘোরে অসুস্থ মায়ের অসহায় মুখখানি দেখে সে কাঁদে। এমনিতেই সে মানুষের বেদনাবিধুর কিংবা বিরহকাতর মুখ দেখতে চায় না, মোটেই সহ্য হয় না বলে। মায়ের কথা তার মনে আসামাত্র অশ্রুকণারা জলোচ্ছ্বাসের আয়োজন করে। কেননা মা যে অজস্র মধুময় স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন তাঁর সন্তানের জীবন। পৃথিবীতে মানুষের সমাজে যতোগুলো পারিবারিক পদনাম আছে, এরমধ্যে সবচেয়ে আপনসৈবচেয়ে উত্তমসৈর্বোৎকৃষ্ট পদনাম হলো, মা! সে চায়, সে প্রার্থনা করে, সবসময়, মানে যতোদিন এই পৃথিবীতে মা বেঁেচ থাকেন, যেন সুখে-শান্তিতে সুন্দর পবিত্রময় থাকেন। মায়ের কষ্টমাখা মুখ দেখা দূরে থাক, কল্পনায় আসলেই সে বিচলিত হয়ে ওঠে। জীবনযন্ত্রণা থাকুক দুনিয়ার আর সব মানুষের জন্য। মাকে যেন সংসারের যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন যাপন করতে না হয়। খোদা তো নারীকে মা পদনামে অলংকৃত করার আগেই এক পৃথিবী কষ্ট দিয়ে দেন। কিন্তু তারপরও কেন এই দুনিয়াতে লাখো লাখো সন্তানের মা দুঃখের দরিয়ায় ভাসতে থাকেন আজীবন ৈতার বোঝে আসে না! সে টাকা পাঠায় মায়ের জন্য, সবার জন্য। ছোট ভাইটা জানিয়েছে, প্রতিমাসে পাঠানো টাকার বান্ডিলগুলো প্রথমেই নিয়ে মায়ের হাতে দেয়। পরে মা তুলে দেন তা বাবার হাতে। সে তা জেনে খুশি হয়। প্রতি সপ্তাহে টিপু তার মায়ের খবর নেয় টেলিফোনে। মায়ের সাথে কথা বললেই সে দেখে- হৈমন্তী সকালের শিশির ভেজা স্নিগ্ধতা এসে, কাশফুলের শুভ্রতা এসে, তার শরীর-মনে প্রশান্তি ছড়িয়ে যায়; তার সকল দুঃখবোধ মুছে দেয়; এবং সে দেখে মুহূর্তেই তার শৈশব এসে খিলখিল করে হাসতে থাকে। তার মনে পড়ে ৈখালাম্মা বলেছিলেন, শৈশবে মা সারাক্ষণ চাইতেন, তাঁর বুকের মানিকটা অপার আনন্দে থাকুক। নানী বলতেন,‘ঘুমের মইদ্যে আদর করিস না, রাগী মানুষ হইবে।’ হোক। ওসব মানতেন না মা। তিনি তাঁর সুন্দর নিষ্পাপ শিশুর ঘুমন্ত মুখটির অনিন্দ্য সৌন্দর্য চোখভরে দেখে মুগ্ধ হতেন। মা নিজের সব দুঃখ ভুলে যান। যখন দেখেন ফেরেশতা এসে খেলছে তাঁর বাপজানের সাথে। তাই সে ঘুমের মধ্যে হাসে। মা খুশি হন; মায়ের মুখমন্ডলে দুনিয়ার উৎকৃষ্ট সৌন্দর্যগুলো এসে জমা হয়। মা ছেলেটির কপালে চুমু দেন। টিপুর জন্মের তিন সপ্তাহ পর প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ মশকরা করে বলেছেন,‘ মাথাটা লম্বা,নাকটা ছোট, রঙ অতোটা ফর্সা না, হাত-পাগুলো বেটে বেটে, চোখগুলো ছোট ছোট ইত্যাদি। মা বলেছেন, ‘আমার আসমানের চান; আমার আদরের দুলাল, আমার জান, আমার বাবা; দেখবে তোমরা বড়ো হয়ে আমার নয়নমণি সারা দুনিয়া উজালা করবে।’ খালা বলেছেন, তার মনে পড়ে, বাল্যকালে যখন একটু একটু হাঁটা শেখা হয়, সেই সময়, মা যে কতো প্রকারের আনন্দে হেসে খেলে মাতিয়ে রাখতেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এক-দুই কদম হাঁটা দেখলেই মা আনন্দে উল্লসিত হয়ে সবাইকে ডাকতেন। একটা-দুটো নতুন শব্দ উচ্চারণ করা মাত্র মা কী যে খুশি হতেন, কোলে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, চুম্বনে-চুম্বনে সমস্ত মুখমন্ডল ভরিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘বলো বাবা, বলো, আম্মা, আমি ভাত খাবো, দুধ খাবো, মিষ্টি খাবো, চকলেট খাবো চকলেট।’সে বলতো, ‘তকলেত কাবো, আম্মা, আমি মিত্তি কাবো।’ ব্যস, আম্মা অনেক খুশি। আম্মাও বলেন, ‘তকলেত কাবো, আম্মা!’ একবার নাকি বারান্দার পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে টিপু পড়ে গিয়েছিলো নিচে। তেমন একটা ব্যথা পায়নি। ভয় পেয়ে কেঁদেছে। মা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে কোলে উঠিয়ে বুকে চেপে ধরেন পরম মমতায়। মুহূর্তেই সব ভয়-বেদনা খালাস! মা তাঁর সমস্ত শরীর খুঁজে দেখলেন, কোথাও আঘাতের চিহß আছে কিনা। না, পাওয়া যায়নি। তবু মা জিজ্ঞেস করেন,‘কোথায় লেগেছে, বাবা?’ সে ধুলোমাখা হাঁটু দেখিয়ে বলেছে,‘ একানে।’ খুব সামান্যই লেগেছে, কিন্তু মা অতি যত্নে ঐ জায়গাটা মালিশ করে ওখানে চুম্বন দিয়ে জানতে চেয়েছেন‘ৈ এখন ভালো হয়েছে, বাবা?’ সে মাথা নাড়িয়ে বলেছে,‘ বালা অইতে।’ নানী বলেছেন, খালা বলেছেন, দাদি বলেছেন, বাবাও বলেছেন, তার জন্মের কিছুদিন পর থেকেই তার মায়ের মস্তিষ্ড়্গ বিকৃতি ধরণের লক্ষণ দেখা দেয়। দিনের পর দিন ঘুম নেই, খানাপিনার প্রতি খেয়াল নেই। কাউকে দেখলে কেবলি হাসেন। কখনো বিস্তারিত ফসলের মাঠ দেখে কিংবা কখনো কোনো উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে দিগন্তজোড়া দুপুরের স্তব্ধ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। যেন তাঁর কাছে এই দুনিয়া, এই জগতের সকল প্রকার আয়োজন বড়োই হাস্যকর। একদিন ছোট খালাম্মা টিপুকে পাশের বাড়ির একটি নিভৃত কক্ষে লুকিয়ে রেখে এসে তার মাকে বলেন, ‘কইগো বড়ো আপা, টিপু কই? ঘুমিয়ে গেছে?’ খালাম্মার উদ্দেশ্য ছেলেটির জন্য তার মায়ের মায়াটুকু পরীক্ষা করা। মা বলেন, ‘না না , আমার কাছে তো সে নেই, কী বলিস? কই গেলো? কে নিলো?’ বলতে বলতে হুড়মুড় করে উঠে, দিশেহারার মতন এদিক-ওদিক দেখে, ‘টিপু-উ-উ-উ, বাবা টিপু!’ ডাকতে ডাকতে দ্রুতপায়ে যান প্রথমেই পুকুর ঘাটে। ঐ জায়গাটা বেশি বিপজ্জনক। আড়াই বছরের ছেলে টিপু। পুকুর ঘাটে কেউ নেই! তাহলে কোথায় গেলো? খালাম্মা ভাবেন, বড়ো আপাকে বেশি পেরেশান করা ঠিক হবে না, বেচারি এমনিতেই অসুস্থ। তিনি বুঝে ফেলেছেন বড়ো আপার মাথাটা কিছু খারাপ হলেও পুত্রের মায়া ষোলো আনা। তাই মা পুকুর ঘাটের দিকে গেলে খালাম্মা একদৌড়ে গিয়ে পাশের বাড়ি থেকে টিপুকে নিয়ে আসেন। মা পুকুর ঘাট থেকে ফেরত আসতেই দেখেন টিপু খালাম্মার কোলে। মা তাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মায়ের কোলে সে এইমাত্র ফোটা ফুল। সে উল্লসিত হয়ে, উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু বলতে চায়। বলে, ‘আমি আম্মা···আমি আম্মা··· ঐ বালি··· আমি আম্মা ঐ বালি··· ঐ ঐ ঐ কালাম্মা···।’ খালাম্মার দিকে চেয়ে হাসে। সে বলতে চায় যে, খালাম্মাই তাকে ঐ বাড়িতে রেখে এসেছেন। কিন্তু ভাষা বরাবর ফুটে উঠছেনা। খালাম্মা তার বড়ো আপার বকুনি থেকে বাঁচার জন্য টিপুর অস্পষ্ট কথার অন্য অর্থ করেন। বলেন, ‘হঁ্যা হঁ্যা, টিপু বলতে চাইছে যে, আমিই তাকে খুঁজে বের করেছি।’ খালাম্মা হাসেন। টিপু হাসে। আম্মাও হাসেন। মা বলেন টিপুকে, ‘তুমি কোথাও যেও না, বাবা, একলা, আম্মা কানতে কানতে মরে যাবো।’ সে বলে, ‘না আম্মা, আমি দাবো না।’ বাড়ির সকলে বলাবলি করেন, মাথায় একটু সমস্যা হলে কী হবে, হাজার হোক, মায়ের পরানে সন্তানের জন্য মায়া ষোলো আনা। মায়ের নিজের খানাপিনা, ঘুমের খেয়াল নেই। কিন্তু ছেলেটাকে ঠিকই সময়মতো যত্ন সহকারে গোসল করিয়ে, কাপড় পরিয়ে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেন। এই কাজটা তিনি আর কাউকে করতে দেন না। অবশ্য অনেক অনেক ডাক্তার কবিরাজ বৈদ্য দেখানোর পর ঘুমের ওষুধটাই মায়ের স্থায়ী চিকিৎসা হিসাবে তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে। ঘুমের ওষুধ খেলে তাঁর ঘুম হয়, তিনি সুস্থ। না খেলে তিনি অসুস্থ। টিপুর চেহারাটা তার মায়েরই চেহারার নব্বইভাগ কপি। আজকাল কেউ মায়ের প্রসঙ্গ তুললেই তার চোখে পানি আসে। আহমাদ মোস্তফা কামাল’র ‘সম্পর্ক’ উপন্যাসটিতে মায়ের কথাগুলো পড়তে সময় তার চোখ সজল হয়ে ওঠে। তমিজ উদদীন লোদী’র ‘গড়খাই’ উপন্যাসে মায়ের প্রসঙ্গে কিছু দরদী কথা পড়ে তার মাতৃমায়া উছলে উঠেছে। ‘পিপাসার প্রান্তরে ফেরা’তে আল মাহমুদ যখন মায়ের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে গিয়ে মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করেন, তখন টিপুর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে এই ভেবে যে, খোদা না করেন প্রবাসের পেশাগত জটিলতার গহ্বরে আটক থাকতে থাকতে যদি মা এই দুনিয়া ···। নাহ! সে আর ভাবতে পারে না। অশ্রুকণারা জলোচ্ছ্বাসের আয়োজন করে। সে একটা গান শুনে। ভারতীয় বাংলা গান। ‘মধুুর আমার মায়ের হাসি, চাঁদের মুখে ঝরে মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।’ এই সাদামাঠা কথার গানটিতে যিনি সুরারোপ করেছেন সেই লোকটি নিঃসন্দেহে একজন মহান সুরকার। এই গানটির কথা ও সুরে বিস্ময়কর সম্মোহনী শক্তি আছে। পলকেই হßদয়ের গভীর গহন স্পর্শ করে ফেলে। তার গাল বেয়ে জলধারা নামে। আহা মা! এতো প্রিয় একটি মানুষ। এই মায়ের মনটার কোনো যথার্থ উপমা খুঁজে পাওয়া যাবে না পৃথিবীতে। মা যে কতো মধুর স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে রাখেন তাঁর সন্তানের জীবন। মা নামাজ পড়ছেন। ছেলেটি আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। কখনো সেজদার জায়গায় বসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে, কখনো মা সেজদায় গেলে পরে সে ঘোড়ায় চড়ার মতো মায়ের পিঠে চড়ে বসে হি হি হি হি করে হাসতে থাকে। মা সেজদার তসবিহ তিনবারের বদলে একুশবার পড়েন। আস্তে আস্তে সেজদা থেকে ওঠার সময় মাকে খেয়াল করতে হয়, ছেলেটি উল্টে পড়ে যাবে কি না। তিনি সালাতের মগ্নতা সত্ত্বেও একহাতে ছেলেটিকে ধরে রাখেন। নামাজ শেষে মা মোনাজাত করেন। দ্বীন-দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করেন। রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া··· পড়তে পড়তে মায়ের গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে। ছেলেটি সেই অশ্রু মুছে দিয়ে মায়ের গালে চুম্বন দিতে থাকে। মা মোনাজাত শেষে ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করে ছেলের বুকে মুখে মাথায় ফুঁ দেন। ছেলে বলে, মানে টিপু বলে,‘অইতে, এখন তকলেত দিলাও, আম্মা।’ মা বৈয়াম থেকে চকলেট বের করে দেন। এই হলো এক মা ও পুত্রের ভালোবাসার থোড়া-বহুত অনুস্মৃতি। বলতে পারেন অনুরাগ মাখা অল্পকিছু অনুচিন্তন ৈঅ্যা লিটল কনটেমপ্লেশন অব দ্য পাস্ট অব অ্যা বিলাভড সান, হু হ্যাজ বিন সেপারেটেড ফর সি ইয়ারস। আরও একটু বলি, অন্যদিক থেকে। সে সাধারণত এই বয়সে এসে কাউকে ভিক্ষা দেওয়া কিংবা করুণা করা মোটেও পছন্দ করেনা। সে মনে করে ভিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে করুণাপ্রার্থী হতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনি বয়স্ড়্গ মহিলাগুলো, ইরাকি বিধবা নারীগুলো, যাদের পুত্রসন্তান যুদ্ধে মারা গেছে বলে টিপুর দোকানে এসে সাহায্য চায়। বলে,‘ইনতা মিতিল ইবনি, ইয়া বাবা, সা’য়াদনি (তুমি আমার ছেলের মতো, বাবা, আমাকে সাহায্য করো!)। সে গলে গিয়ে দরদী হয়ে ওঠে, পাঁচ-দশ দিরহাম দিয়ে দেয়। আবুধাবিতে তার তৃতীয় বছর পূর্ণ হওয়ার পর মাকে একটি চিঠি লিখে জানাবে মনস্থ করেছিলো। কিন্তু চিঠিটি লিখেছে পঞ্চম বছরের পর, ষষ্ঠ বছরের শুরুতে। সেই চিঠিটা মায়ের হাতে পেঁৗছে নি। মনে হয় পোস্টবঙ্অলারা বহুত পেয়ারসে চিঠিটা পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় পাঠিয়েছিলো বলে মাঝপথে চাইনিজ ড্রাগন খেয়ে ফেলেছে। দেখুন পত্রখানাৈ
‘আম্মা, আসসালামুআলাইকুম, আমি জানি, আমার জন্য আপনি কাঁদেন। আমিও আপনার জন্য কাঁদি। কিন্তু কী করবো মা, তকদিরটাই এরকম যে, মা-বাবা ভাই-বোনদের সাথে আমার থাকা হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নতাই না কি এই জামানার আধুনিকতা। আবেগতাড়িত হয়ে ধুম-ধাড়াক্কা সকল জটিলতাদের কানে ধরে নিয়ে আরব সাগরে ডুবিয়ে মেরে তো চলে আসতে পারি দেশে। কিন্তু সেটা হবে দায়িত্বজ্ঞানহীন কান্ড। গত কয়েক বছর ধরে যতোবার দেশে আসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি, ততোবারই একদল জটিল সমস্যা এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। বলেছে, ‘এ অবস্থায় যেতে পারবে না।’ আম্মা, চাকরির যন্ত্রণা সইতে না পেরে ঋণ-হাওলাত করে ব্যবসার বোঝা কাঁধে নিয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশাটা নিলাম এই জন্যে যে, এতে উপার্জনের পাশাপাশি স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করা যাবে। অথচ জীবনের এই পর্যায়ে এসে দেখতে পাচ্ছি, নিরংকুশ স্বাধীনতার সুখ বলতে কিছু দুনিয়াতে পাওয়া যায় না। এক বন্ধন থেকে অন্য বন্ধনে স্থানান্তর হওয়া মাত্র। মানুষের দায়বদ্ধতা-দায়িত্বজ্ঞান অসংখ্য কঠিন শৃঙ্খল তৈরি করে। এই শৃঙ্খলে ৈএই শিকলে একজন সুস্থ মানুষকে বাঁধা থাকতে হয়। আম্মা, প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মানুষের সাথে এখানে লেনদেন করছি। বড়ো বিস্ময়কর এই মানুষের সংসার! সকল প্রকার মানুষের মধ্যে একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, স্বার্থপরতা। নিজস্ব প্রয়োজন এবং পছন্দটাকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়। আর এই লক্ষে জীবনটা ধরে রাখতে গিয়ে মানুষ কিছু পাপ, কিছু অপরাধ, কিছু পূণ্য, কিছু কল্যাণ করে যায়। এক মিশরীয় সেনা সদস্য শাদা পোশাকে মার্কেটিং করতে এসে, আমার দোকান থেকেও কিছু কেনাকাটা করেছিলো বছরখানেক আগে। জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার দু’দিন পর সে আমার দোকানের রসিদটি দেখিয়ে একই নামের অন্য জিনিস আমার দোকান থেকেই নিয়েছে ব’লে তা ফেরত দেওয়ার জন্য পুলিশ নিয়ে আসে। আমি পুলিশকে জানাই লোকটি মিথ্যাবাদী। সে আমাকে ব্লøাকমেইল করতে চায়। পুলিশ ফেরত চলে যায়। মিশরীয় লোকটি আদালতে গিয়ে মামলা দায়ের করে। আদালত আমাকে ডাকে। দীর্ঘ ন’মাসে আদালতের সাতটি এজলাসে হাজিরা দেই। বিচারক আমাকে উকিল নিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি জানাই, আমার বক্তব্য আমিই বলবো। প্রথম কয়েকটি বৈঠকে মিশরীয় লোকটি বিচারকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে, কেঁপে কেঁপে, ভয়ে ভয়ে কথা বলেছে। আমি সবসময় নির্ভয় থেকে সোজা-সাবুদ জবাব দিয়েছি। শেষের ক’টি বৈঠকে সে উকিল নিয়োগ করে। তবু আম্মা, অবশেষে আল্লাহর রহমতে, আপনার দোয়ায় আদালত আমাকে বেকসুর ঘোষণা করে। আর অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় মিশরীয় লোকটির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। পরে জেনেছি ঐ মিশরীয় লোকটি তার এলাকায় একজন জনদরদী দানশীল ব্যক্তি বলে পরিচিত। আম্মা, দেশ থেকে সাংবাদিকতা ছেড়ে এসে প্রবাসে সম্পূর্ণ অন্যরকম পেশায় নিয়োজিত থেকেও বইপড়া এবং লেখালেখির নেশাটা একেবারে ছাড়তে পারি নি। কেন জানি না মা, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ,শেপিয়র,বায়রন,মিল্টন,প্লুটো,অ্যারিস্টটল,বাট্রান্ড রাসেল প্রমুখদের জীবন ও কথা আমার খুব ভালো লাগে। এই মানুষগুলো জীবন ও জগতকে কতো রূপে, কতো রঙে যে দেখে, কতো বিচিত্রভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আম্মা, আমি একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। দেখি, আমি পথ চলতে গিয়ে ইচ্ছে করলেই দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরে কিছুদূর অনায়াসে উড়ে যেতে পারি পাখির মতন। এই উড়তে পারাটা আমি স্বপ্নের মধ্যে খুবই উপভোগ করি। আরেকদিন দেখেছি, বেশ স্বচ্ছন্দেই একটি উঁচু দালানের উপর থেকে, সম্ভবত পাঁচ-ছয়তলা, লাফ দিয়ে নিচে নেমে এসেছি। এতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং মনে হয়েছে কৈশোরের দিনগুলোতে যে-রকম কখনো পেয়ারা গাছ থেকে, কখনো জাম গাছ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে আসতাম, আর আনন্দিত হতাম, ঠিক সে-রকম আনন্দ এসে আমাকে কাতুকুতু দিয়েছে। অবশ্য দু’বছর আগে একটা অন্য ধরনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখেছিলাম, আমরা ক’জন একসাথে একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনে দেখি, প্রায় একশ’ হাত দূর থেকে একটি বাঘ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আমার সাথিরা দ্রুত আড়ালে পালিয়ে যায়। আমি পালাইনি। বাঘটা এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই আমি প্রচন্ড শক্তিমত্তার সাথে বাঘটির সঙ্গে কুস্তি-লড়াই করতে থাকি। আর লড়াই করতে থাকা অবস্থায় ঘুম থেকে জেগে উঠি। যাক আম্মা, আজ আর না। আমার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না। আমি ভালো আছি। আমার ব্যবসা ভালোই চলছে। আপনার দোয়া আমাকে সবসময় সকল প্রকার অমঙ্গল থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি। ইতি, আপনার আল্লাহর ধন ৈটিপু।”
এই চিঠিটা মায়ের হাতে পৌঁছে নি। অবশ্য চিঠির কথাগুলো সে মাকে টেলিফোনে বলেছে। মা সব কথা শুনে বলেছেন,‘ আল্লাহর রহমত সারাক্ষণ তোমার সাথে থাকুক, এই দোয়া করি, বাবা।’ এমনিতেই টিপুকে তার মায়ের স্মৃতি বিজড়িত বালক বয়সের দিনগুলো আন্দোলিত করে। একদিন সে ক্যারিবীয় লেখক জ্যামাইকা কিনকেইড এর ‘মাই মাদার’ গল্পটি পড়ে অভিভূত হয়েছিলো। বইটি, মানে ‘ক্যারিবিয়ান ওয়েভ’ বইটি ওর হাতেই ছিলো। আবুধাবি শহরের একটি বড়ো সড়ক ধরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পায়ে চলার পর, পাঠানদের মার্কেট বলে পরিচিত বাজার এলাকায় ঢুকেই এক বেলুচি দোকানের বারান্দায় বসে। অন্তত দশ মিনিট বসলেই ক্লান্তি শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। তাই সে বসেই বইটি খুলে ‘মাই মাদার’ গল্পটি পড়তে শুরু করে। গল্পটির প্রথম কয়েকটি লাইন অত্যন্ত হßদয়স্পর্শী। টিপুর মাতৃমায়াবেগে দোলা লাগে। মুহূর্তেই জনম নেয় লাখো লাখো অশ্রুকণা। জ্যামাইকা খুব সাবলিল ভাষায় কী লিখেছেন দেখুন‘ৈ আই ওয়াজ সরি অ্যান্ড ক্রাইড সো ম্যানি টিয়ারস দ্যাট অল দি আর্থ অ্যারাউন্ড মি ওয়াজ ড্রেঞ্চড। স্ট্যান্ডিং বিফোর মাই মাদার আই বেগড হার ফরগিভনেস, অ্যান্ড আই বেগড সো আর্নেস্টলি দ্যাট শি টুক পিটি অন মি, কিসিং মাই ফেস অ্যান্ড প্লেসিং মাই হেড অন হার বুজম টু রেস্ট। প্লেসিং হার আর্মস অ্যারাউন্ড মি, শি ড্রিউ মাই হেড ক্লোজার অ্যান্ড ক্লোজার টু হার বুজম, আনটিল ফাইন্যালি আই সাফোকেটেড। আই লে অন হার বুজম, ব্রেথলেস, ফর অ্যা টাইম আনকাউন্টেবল।’ সন্দেহ নেই জ্যামাইকা উঁচুমানের ভাষাশিল্পী। তাঁর গল্পের অন্তর্জগত পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র। খামাখা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার ফুলেল চাদর দিয়ে তিনি তাঁর গল্পকে ঢেকে রাখেন না। টিপুও তাই মনে করে। তো আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কেন জানি একটু বেশিই টিপু তার মাকে নিয়ে ভেবেছে। দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার পথে প্যান্টের পকেটের মোবাইলটি কেঁপে উঠে মেসেজ আসার সিগনাল দেয়। হাতে নিয়ে দেখে স্বদেশ থেকে এসেছে এসএমএস। ছোট ভাইটি পাঠিয়েছে। ‘ভাইসাব, আম্মা অসুস্থ। আপনাকে দেখতে চান। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু তিনি কথা বলেন খুব আস্তে। পারলে চলে আসুন দেশে।’ এসএমএস এর এই কথাগুলো পড়ে পলকেই টিপুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। সে চৌরাস্তার মোড় পার না হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অস্পষ্ট দৃষ্টি মেলে ধরে আকাশের দিকে। আকাশ নীরব দর্শক। টিপু দেখে সে সুশৃঙ্খলভাবে কোনো কিছু ভাবতে পারছে না এই মুহূর্তে। রাস্তা পার না হয়ে পাশের পার্কটির একটি বেঞ্চে গিয়ে বসে। বিপর্যস্ত সে। তার মনে হয়, ভারত মহাসাগরের সৃষ্ট ৎসুনামির প্রভাবে যে-রকম ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকাকে প্রবল জলোচ্ছ্বাস এসে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো, ঠিক সে-রকমই একটি ছোট মেসেজ টিপুর চিন্তা-চেতনা-মনোজগতকে উলটপালট করে দিয়েছে। প্রায় দশ মিনিট বসে থেকে সে উঠে দাঁড়ায়। পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সির স্টাফ আশরাফ উদ্দীনের মোবাইলে ফোন করে। বলে, ‘আশরাফ ভাই, আজ রাতেই আমাকে দেশে যেতে হবে। আমার জন্য বিমানের টিকিট ওকে করে রাখবেন। আমি বিকেলে আপনার সাথে দেখা করবো। আম্মা অসুস্থ। মেসেজ পেয়েছি একটু আগে।’ আশরাফ উদ্দীন বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি রাখবো টিপু ভাই, অবশ্যই রাখবো। অন্য একটা সিট বাতিল করে হলেও আপনার সিট রাখবো।’

<><><><>পুনশ্চ ঃ গল্পে ব্যবহßত আরবি কথাগুলো আরব দুনিয়ার কথ্যভাষা।
সারওয়ার চৌধুরী