Pages

Wednesday, May 21, 2008

কবি'র অনুভূতি, কেরামতি, মর্যাদা এবং কবিতা-শিল্পের জিওন মরণ

কবি'র অনুভূতি বা শিল্পের কেরামতি

শিল্প নিয়ে যারা মাথা ঘামান, তাদের প্রায় সবারই জানা, শিল্প- মিথ্যার মাধ্যমে সত্য তুলে ধরে আর শিল্প অদৃশ্য এক মোহন মায়া।কবি সুন্দরের আরাধনা করেন; শিল্পের সাধনা করেন। কবি'র অবলম্বন ভাষা। তিনি সতত আন্দোলিত তার ভাবের জগতে। তিনি পাথরকেও কাঁদতে দেখেন। আকাশ তাঁর সাথে কথা বলে। বাতাস কানে কানে কিছু বলে যায়; বনের অচিন পাখিটির ভাবজগতকেও দেখেন; ফুলের সুরভীকেও নৃত্য করতে দেখেন, স্বদেশ স্বকৃষ্টিকে ধর্ষণ হতে দেখেন। আর দেখেন দৃষ্ট বাস্তবতার বাইরের পরাবাস্তবকে। এবং দেখেন যাদু বাস্তবতা ও বস্তুর অন্তর্গত বাস্তবের বুনন। এই দেখাটা হয় কবি'র শিল্পতৃষ্ণাবোধ থেকে, অন্তর্গত সুচেতনার মোহন তাগিদ থেকে। ক্ষেত্র বিশেষে কবি জ্বলে ওঠেন বিক্ষুব্ধ চিতার মতো, ক্ষ্যাপা শিম্পাঞ্জির মতো। তিনি রূপকে উপমায় উপলব্দির সারাৎসার প্রকাশ করেন শব্দের সুন্দরতম বুননের মাধ্যমে। কবি'র ভাষাতে ব্যাকরণ ফেটে চৌচির হয়। শৃংখলা ভংগ হয়। কবি তাঁর শিল্পের স্বপক্ষে নুতন শৃংখলা গড়ে তোলেন; সুষমামন্ডিত করেন তাঁর নিজস্ব ব্যঞ্জনা। তাই প্রচলিত ব্যাকরণে অভ্যস্ত মানুষও কবি'র সৃষ্ট ভাষার শৃংখলাকে গ্রহন করে সানন্দে। কখনো বিস্তারিত সময় সাপেক্ষে। কখনো কবিতার অন্তর-কথা বোধগম্য না-হওয়া সত্বেও মায়া লাগে। এটাকে হয়তো বলা যায় কবি'র অনুভূতির কারিশমা বা কবিতা-শিল্পের কেরামতি।কবি'র অনুভূতি অন্যান্য মানুষের মতো হয়েও আলাদা। অনুভূতি হলো মনোদৈহিক ক্রিয়ার ফল। দৃশ্য থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে কবি শৈল্পিক ব্যঞ্জনাসমেত প্রকাশ করতে চান। সেখানে ঘটনার প্রতিবেদন থাকার পাশাপাশি থাকে অন্তর্গত সত্যের প্রকাশ। কবি তাঁর অনুভবকে প্রকাশ করতে চান সৎভাবে। হোক সেটা কোনো দৃষ্ট বাস্তবতার অন্তর কিংবা তাঁর নিজস্ব সুররিয়েল মেটাফরের কথা। কিন্তু কখনো তাঁর সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অজ্ঞজনেরা।কবি ও কবিতার মর্যাদাযুগ যুগ ধরেই কবি ও কবিতার মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আসছে কিছু মানুষ। কিন্তু কবি ও কবিতার জনম থেমে যায় নি। যাবেও না। সক্রেটিসও কবিদের দেখতে পারতেন না। অথচ কবিরাই মানবসভ্যতাকে সুষমামন্ডিত করেছেন। তাই বলা হয়ে থাকে মানবজাতির শ্রেষ্ট আবিস্কার কবিতা। কবি বিজ্ঞানীকে উদ্বুদ্ধ করেন। ম্যাটাফিজিক্সকে খুলে খুলে দেখাতে পারেন কবি। দেশে দেশে কবিরা নুতন নুতন অধরা মাধুরী আবিস্কার করেন, উদ্ভাবন করেন কবি। তাঁর মগ্নচৈতন্য শাণিত থাকে। মনোলোক থেকে কেটে কেটে বা চিরে চিরে বের করেন সুষমা। তিনি তৃষ্ণার্ত সারাক্ষণ। পিয়াস মিটে না। দৃশ্যের বা কল্পদৃশ্যের অন্তর সহবাসে, সহস্র সন্তান জনম দিয়েও তিনি ক্লান্ত নন। মিলনে মিলনে মৃত্যুর দিকে যেতে আলোকিত হতে থাকেন, আলো ছড়িয়ে দেন। কবি'র মন ও মনন আমৃত্যু সবুজ শ্যামল।তবু দেশে দেশে কবি ও কবিতার অবহেলা হয়েছে অনেক। অতীতের গহবরে চলে যাওয়া সময়ে অজস্র প্রমান আছে বহু কবি'র কাব্যকৃতি আচ্ছাদিত ছিলো। আবার অতীত খুঁড়ে বিগত কবি ও কবিতার যথাযথ সম্মানও দিয়েছেন কেউ কেউ। গুণী গুণ শনাক্ত করতে পারেন। গত শতকের এক আলোকোজ্জল কবি টি এস এলিয়ট। তিনি অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে তার সময় থেকে দু'শ বছর আগে পৃথিবীতে আসা কবি ও কবিতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই আমরা চিনতে পারি, বিস্ময়কর কবি জন ডান, এ্যানড্রু মারভেল প্রমুখ কবি'র কবিতা। আমাদের আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পূর্ণ নির্মোহ অবস্থান থে'কে উদ্ভাসিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ কে।এখানে বলা ভালো, কবিতার শিল্পগুণ বিচারক যদি হয় রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট; যদি হয় কুয়োর ব্যঙসদৃশ পন্ডিত তাহলে তার কাছ থেকে কবি বা কবিতা-শিল্পের যথাযথ মর্যাদা পাওয়া যায় না। কেননা ওই বিচারক বা সমালোচক রাজনৈতিক উপযোগিতার দিকেই খেয়াল দ্যায় বেশি। কবিতার বা সাহিত্যের সমালোচনা অবজেকটিভ হোক কিংবা সাবজেকটিভ হোক, নিষ্ঠাবান সমালোচককের দৃষ্টি হতে হবে রাজনৈতিক চেতনামুক্ত। পন্ডিত কবি এলিয়ট তা দেখিয়ে গেছেন পুংখানুপুংখভাবে।আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ছায়ায় কবিদের রাখা হয় বা রাখার চেষ্টা চালানো হয়। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচকও আছেন। যাদের কাজ 'তেল দেয়া' নয় 'বাঁশ দেয়া'। ওখানে প্রকৃত শিল্পের কদর কখনো কাকতালীয় নজরে পড়ে। খুব অল্প সংখ্যক ছাড়া আমাদের সাহিত্যের, শিল্পের, সৃজনশীল সমালোচক নেই।বিশুদ্ধ কবিতা বিশুদ্ধ শিল্পের নিজের কোন পক্ষপাত নেই। সে যার হাত ধরেই আবির্ভূত হোক, সে সকলের হয়ে যায়। শিল্প সেই নিষ্পাপ ফুটফুটে শিশুটিরও মতো, যাকে শতধা বিভক্ত প্রতিটি মানুষের ভালো লাগে; কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হয়। আবার, কবিতা-শিল্প সুর্যালোকের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মির মতোও সংহারী। কবিতা-শিল্প আংকিক বিজ্ঞানীর সূত্র অন্বেষণের ইশারাও দ্যায়। কবিতায় স্ফুট কল্পদৃশ্যের দর্শন বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসার দিক নির্দেশও করে। এ্যারোপ্লেন আবিস্কারের অনেক আগে কবিরা মানুষকে পাখির মতো উড়িয়েছেন দেশে দেশে! বহুবিধ কবিতায় টেলিপাথিক বাস্তবতার দৃশ্যকল্প এসেছে। আইনস্টাইন নিভৃতে বেহালা বাজিয়েছেন, কবিতা পাঠ করেছেন, শিল্পের মায়ায় নিজেকে জড়িয়েছেন।কবিতা-শিল্পের জিওন মরণপ্রাচীন কবিতা, মধ্যযুগীয় কবিতা, সাম্প্রতিক কবিতা, আধুনিক কবিতা এসব বলার আসলে কোনো মানে নেই মনে হয়। গতকাল লেখা একটি কবিতা যদি দেখা যায়, প্রতিপঠনে অন্তর নাড়া দ্যায় না, সুগভীর উপলব্ধিকে ধারণ করে না, শৈল্পিক মায়ায় জড়ায় না, সে-কবিতা জনমের পরের দিনই মৃত হতে পারে। আর অর্ধ শতাব্দী আগে লেখা কবিতা যদি আজকের পঠনে শিহরণ দ্যায়, সে-কবিতা জীবিত। বোধে বিপ্লবে ভালোবাসায় তার সম্মান অক্ষুন্ন। এই বিপ্লব রাজনীতির নয়, হৃদয়বৃত্তির বিপ্লব। যেখানে মানুষ শুধু মানুষের ধ্রুপদী চেতনার ব্যঞ্জনা, মুখোশহীন মানুষের বন্দনাও বিধৃত। আমাদের মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, দিলওয়ার, নির্র্মলেন্দু গুণ প্রমুখের অনেক কবিতা-শিল্প যুগ যুগ বেঁচে থাকবে। (উদ্ধৃতি দিতে পারছি না, প্রবাসী এই অধমের সংগ্রহে নেই প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি । পূর্ব পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।) তাছাড়া আমাদের বিশাল লোক সংগীতের ভান্ডারের আবেদন হারিয়ে যাবার নয়।বহুশ্রুত প্রতিটি লোক সংগীত একেকটি অনুপম কবিতা-শিল্প। আর হোমার দান্তে শেক্সপিয়র মিলটন এবং ম্যাটাফিজিক্যাল কবি গ্যাটে রুমি হাফিজ ইকবাল প্রমুখের কবিতা-শিল্পও মরে যায় নি। ইসলামপূর্ব সময়ের দুর্দান্ত আরব প্রেমের কবি ইমরাউল কায়েস আজো অম্লান। সেই সময়ে উকাজ নামক স্থানে বাৎসরিক কবিতা উৎসবে তৎকালের সাত জন কবি'র শ্রেষ্ট কবি ছিলেন এই কায়েস। তাঁর প্রিয়তমার নাম ওনয়জা। দারতুল জুলজুল নামের স্নান উদ্যানে প্রিয়তমাকে এক নজর দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে যেতেন। পথে পথে খেজুর গাছের তলায় পড়ে থাকতেন কায়েস। তাঁর কবিতার সুষমা মনোমুগ্ধকর। জানা যায়, ইসলামের নবী সঃ কবি ইমরাউল কায়েসের কাব্যসুষমার প্রশংসা করেছিলেন।(আসলে এই লেখাটি কমপক্ষে আরো তিন গুণ বিস্তার হওয়ার দাবী রাখে। আপাতত ইতি টানলাম। আরো কিছু কথা হয়তো অন্য শিরোনামে পরে বলা যাবে।)