Pages

Wednesday, October 27, 2010

চেতনার বড়াই, বুদ্ধির লজ্জা এবং উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অন্তর কথা

(ব্রাত্য রাইসু'র 'বলো জয় মা তারা বলো নারায়ে তাকবীর' শীর্ষক নোটে ব্রাত্য রাইসু ও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ'র তর্কাতর্কি পাঠ শেষে মন্তব্য আকারে প্রকাশিত নীচের লেখাটি ২১/১০/২০১০ তারিখে।)

ব্রাত্য রাইসুদা এবং সুব্রতদা'র মন্তব্যগুলো পড়ে মনে হলো-শব্দে শব্দে কিলিং গেইম বেশ শাণিত, টনটন!আমি অধম এবার কিছু কথা করিবো বর্ণন!

ধর্ম চেতনা, ভাষার চেতনা, দেশভিত্তিক জাতীয়তার চেতনা এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থের চেতনার দ্বারা মানুষ মানুষে সংঘর্ষ রক্তপাত হয়ে আসছে। প্রতিটি মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত নিজ নিজ জীবন নিয়ে। চেতনাগুলোর সাথে মানুষের কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে থাকাটা বিস্ময়কর বাস্তবতা।

উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাগুলোর পেছনে শুধু ধর্মীয় চেতনা কার্যকর না। শুধু তাকাই না দৃশ্যপটে, দেখতে চেষ্টা করি ভালোভাবে।মানুষকে অসভ্যও বানায় বাজার-লেনদেন/ক্ষমতার লিপ্সা। টিকে থাকার লড়াইয়ে বুদ্ধিজীবিও ক্রেতা বিক্রেতা। বুদ্ধিজীবিও বাজারের তাজা মাল।ষোল সতের বছর আগের কথা, দেশে থাকতে কিছুদিন সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে ছিলাম। চোরা কারবারিদের সাথে একান্তে আলাপ করে বুঝেছি, সীমান্তে গুলি বিনিময়/মানুষ মারার অন্যতম প্রধান কারণ বিডিআর বিএসএফ কর্তক অবৈধ 'মাল কামানো' নিয়ে ভাগাভাগি বরাবর না-হওয়াতে।

বেশ কয়েক বছর আগে, কাশ্মীর ইস্যুতে, হঠাত পেয়েছিলাম,পাকিস্তানী এক টিভি চ্যানেলে (নাম মনে নেই)তিন ধর্ম পন্ডিতের বিতর্ক। তিন মানে হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান। (হিন্দু যদিও স্থানকেন্দ্রিক/দরিয়ার কিনারা কেন্দ্রিক শব্দ, কিন্তু শব্দটি উপমহাদেশের একটি বৃহত জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়কে ধারণ করছে) তো,বিতর্কের এক পর্যায়ে পাদ্রী মিয়াসাহেব প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, বাংলা তরজমা এভাবে- 'ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের যে-সব মুসলিম গোষ্ঠীসমূহ কাশ্মিরের মুসলমানদের জন্য জান কোরবান করতে প্রস্তুত, তারা কেন তাদের ঈমানী ভাই ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য বাদ-প্রতিবাদ করে না জোরালোভাবে? পাদ্রী সাহেব যৌক্তিকভাবে তার প্রশ্নের মধ্যেই এই ইশারা দিলেন যে, ভারতের সাথে ইসরাইলের গভীর কূটনৈতিক তায়াল্লুক আছে। ভারত যদি ফিলিস্তিনে ইসরাইলী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠায়, তাইলে গভীর তায়াল্লুকের তাপ শীতল হয়ে যাবে। আর ঈমানী দরদ সবার জন্য সমানতালে থাকাটাই বিধেয়, কারো জন্য কম কারো জন্য বেশি হবার সুযোগ কই! সুতরাং এখানে ঈমানী দরদ মূখ্য নয়, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অর্থনীতিভিত্তিক স্বার্থের আগুন প্রজ্বলিত। বুঝার বিষয় হলো, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রনমুক্ত করে ওই মুসলমানগুলোকে ভারতের অধীন করার প্রচেষ্টার মানে কি? পাকিস্তানই বা কেন ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদেরকে কব্জায় রাখতে চায়!

আর পাকিস্তানী চেম্বার কমার্স, ইন্ডিয়ার চেম্বার কমার্স, বাংলাদেশের চেম্বার কমার্স নেতা ফায়দা হাসিলের জন্য মোয়ামেলা করে দিলে-জানে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাইয়ের চুক্তিতে সই করে, তখন তারা বেশ রোমান্টিক অনুভবে উদ্দীপিত হন। তখন তাদের মধ্যকার হিন্দু মুসলিম ক্রিস্টান ধর্ম, দেশ, ভাষা চেতনা জিরো ডিগ্রিতে নেমে আসে।আরবদের মধ্যে দেখি, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার চেতনা একেবারে দগদগে। কিন্তু ফায়দা লুটার মওকা পেলে ওদেরও মাথা ক্রিয়াশীল থাকে মুনাফার চেতনা। পরিস্কার বলে, 'ফিল বিজনেস মাআফি আখু আবু' অর্থাত 'ব্যবসাতে বাপ-বেটা বা কোনো প্রকার ভাইয়ালি নাই।' এক সিরিয়ান খুব সিরিয়াসলি বলেছিলো, আমার মায়ের পেটের ভাইটা বেআক্কেল, আর ওই সিন্ধী হিন্দু ব্যবসায়ীটা ব্রেইনি, সে আমাকে অনেক লাভ দেয়, আমার ভাই যদি ওই সিন্ধী হিন্দু ব্যবসায়ীটার সাথে ঝগড়া করে,তাহলে আমার ভাইকে মাইরা ভর্তা বানাইয়া ফেলবো।'!

দুনিয়ার মানুষকে, নেতাদেরকে, বুদ্ধিজীবিদেরকে নাচাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। বোকা নেতারা, বোকা বুদ্ধিজীবিরা একেকটা ইস্যু বানিয়ে বকবক করতে থাকে বছরের পর বছর।

ধরিত্রির দেশগুলোর সীমান্তের লড়াই, ব্যক্তি মানুষের বাড়ী-ঘরের সীমানা নিয়ে লড়াই আর ধান ক্ষেতের আইল ঠেলাঠেলি নিয়ে লড়াই, এইসব লড়াইয়ের পেছনে শুধ মতলব, শুধু স্বার্থ। ধর্ম বা আদর্শ, নৈতিকতার বাঘা বুলি ক্যামোফ্লাজ মাত্র কখনো মনে হয়!

জগতে মুলতঃ সকল শ্রেণীর, সকল জাতের, সকল মতের, বুদ্ধিজীবী, অবুদ্ধিজীবী সকলেই 'লাভের পিঁপড়া' হতে চায়। কেউ 'লোকসানের গোবরে পোকা' হতে চায় না স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে। এথিক্স বেচারা কেবল নীরবে অশ্রু মোছে!

সাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেই সীমান্তে কিলিং হচ্ছে না। অনেকগুলো চেতনার সাথে বৈষয়িক ও রাজনৈতিক হীন তৎপরতা শামিল আছে। ব্যক্তি স্বার্থ ও গোষ্ঠী স্বার্থ আদায়ের প্রয়াসকে স্পিরিটেড আপ করার জন্য, বদ উদ্দেশ্যের চেতনায় মানুষকে যুক্ত করার জন্য উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে ইস্যু বানানো হয়েছে। উজ্জল দৃষ্টান্ত- জিন্নাহ আর নেহেরুর ব্যক্তিগত জিদাজিদিকে 'সাম্প্রদায়িকতা'র রঙ লাগিয়ে মানুষগুলোকে জড়ানো হয়েছে এবং মারা হয়েছে!

উপমহাদেশের কূপমন্ডুক/মূর্খ/অনালোকিত মানুষগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান, আর এটাকে ব্যবহার করে আসছে চতুর শয়তানেরা।

No comments: