Pages

Tuesday, September 18, 2007

আমার দেশের জন্য প্রাণ কাঁদে

আমার দেশের জন্য প্রাণ কাঁদে।
বছরের পর বছর ধরে পরবাসে থে'কে বুঝেছি স্বদেশপ্রেম; বুঝেছি স্বাদেশিকতা; বুঝেছি নিজের দেশ ও মানুষের নৈকট্য ছেড়ে দূরে থাকার যাতনা; বুঝেছি নিজের ভাষার, নিজের সংস্কৃতির, নিজের ভৌগলিক পরিবেশ ও অবস্থানের মাহাত্ম্য।দিবসের কর্মক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে টিভি চালু করি। আমার দেশের চ্যানেলগুলোতে চোখ রাখি। কখনো কখনো পেয়ে যাই চিত্রায়িত মর্মস্পর্শী দেশাত্মবোধক গান-
সব ক'টা জানালা খুলে দাও না..........ওরা আসবে চুপি চুপি, যারা এ দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেলো প্রাণ..............
অথবা
এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে......কিংবামন পাখিটা যায়রে উড়ে যায় ধান শালিকের গাঁয়.......

দেশের দৃশ্য আর সুরের মাধুর্যে হারিয়ে যাই; অন্তরে দোলা লাগে; আবেগে আপ্লুত হই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। আহা আমার দেশ, আমার সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ।আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই-আজকাল অজস্র ভালোবাসার ডাক শুনি। আমার মা বাবা ভাই বোন বন্ধু স্বজন সকলেই হাজারবার ডাকেন আমাকে।

আমার জন্মভুমির সবুজ ঘাস, দিগন্ত বিস্তৃত ধানি জমি আর কৈশোরের স্মৃতি জড়ানো হাকালুকির হাওর এবং দূর পাড়া গাঁ'র ধুলোউড়া মাটিপথের স্মৃতিদৃশ্য আমাকে আকুল করে।আমাকে দু'হাতে ডাকে, গ্রীস্মের দুপুর; দুরন্ত বালক বালিকাদের নদী ও পুকুরে ঝাপ দেয়া, আম জাম কাঁঠাল পাকা সন্ধ্যায় কোকিলের ডাক, বর্ষার ঝিমঝিম বৃষ্টি, শরতের কাশফুল আর সাদা মেঘদের একাকার রূপ; হেমন্তের শিশির ভেজা স্নিগ্ধ সকাল; সোনালি ফসল ভরা মাঠ; নবান্নের উৎসব; কৃষকের প্রাণখোলা হাসি; শীতের নরম রোদের পরশ; আগুনঝরা ফাগুনের আবাহন; দোয়েলদের নেবু শাখায় বসে শিস দেয়া; চা বাগানের ছায়াদানকারী ইউক্যালিপটাসের পাতাগুলোর তিরিতিরি নড়তে থাকা; বায়তুল মোকাররম ও শাহজালাল মসজিদের আজান; সুরমা নদীর উজানে বেয়ে চলা মাঝির গান, আবদুল আলীমের পল্লীগীতি, লালনগীতি, হাসনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, জীবনানন্দ বাবুর কবিতা, বাংলা একাডেমীর বইমেলা, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ, শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, আমার সিলেট শহরের অলিগলি; একান্ত কিছু স্মৃতির জাফলং, মাধবকু্ন্ডের জলপ্রপাত, চট্টগ্রামের ফয়েসলেক, সুন্দরবনের সেগুন জারুল সুন্দরীদের ছায়ায় ব্যাঘ্রশাবকদের খেলা,হরিণের পাল এবং,হাঁ এবং হঠাৎ রেগে ওঠে গর্জে উঠা আব্বার মায়াবী ধমক ইত্যাদি আমাকে গভীর মমতায় ডাকে। আমি এইসবের আহবানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমার প্রতিদিনের সকল কাজের মাঝে এইসবের আকুল আহবান আমাকে আন্দোলিত করে। আসো, এসে যাও, ফিরে আসো নিজের জন্মভুমিতে, আপন মায়ের মাটিতে।মা তো আমাকে সারাক্ষণ ডাকেন- আয় বাবা আয়, অনেক তো রইলি বিদেশে, এবার দেশে ফিরে আয়, আমার বুকের মানিক তুই বাবা, তোকে আমি অনেকদিন পর চোখের সামনে দেখতে পেলে আমার পরাণ জুড়িয়ে যাবে।আমার মায়ের কোন তুলনা নেই। একটি গান মনে পড়ে-মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরেমাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।

জানি, এইসবই আবেগের কথা। স্বপ্নময়তার কথা। জীবন যাপনের বাস্তবতা অন্যরকম। কঠিন কঠোর। পরবাসে আসতে হয়েছিলো অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই। জগত ভ্রমণের সখ জেগেছিলো কৈশোরে। কিন্তু নানান উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত জীবনের এই পর্যায়ে নিজকে ভিন্ দেশের কর্মস্থলে দেখতে ভালো লাগছে না। বেশ ক'বছর পর গত বছর দেশে গিয়েছিলাম। পুরোনো পেশায় (সাংবাদিকতা) ঢুকে যেতে চেয়েছিলাম। ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকও পরামর্শ দিলেন- আরো ক'টা বছর থাকেন বিদেশে। দেশের পরিস্থিতি টালমাটাল। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি জানি, আমার দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক যদি দুর্বৃত্ত না-হতো, আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। আর আমি এও জানি, আমার দেশের অজস্র সূর্য সন্তানেরা মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা ইউরোপ আমেরিকাকে নিজ নিজ কর্মদক্ষতার দৌলতে গৌরবান্বিত করেছে।
আমি নিশ্চুপ নিথর নিস্তব্ধ হয়ে চ্যানেল আইতে দেখি হায়দার হোসেন গাইছেন-
কী দেখার কথা কী দেখছি
কী শুনার কথা কী শুনছি
কী বলার কথা কী বলছি...............

সারওয়ার চৌধুরী আবুধাবী ইউএই

No comments: