Pages

Sunday, December 2, 2007

আমাদের মূর্খতা আমাদের কূপমন্ডুকতা

মানুষ রাজনীতি করে। প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই করে। মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়। জঙ্গলের বন্য প্রাণীরাও ক্ষমতার লড়াই করে। ওদের লড়াই আর মানুষের লড়াইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা কি? পার্থক্যটা কি সাংস্কৃতিক নয়? জঙ্গলের প্রাণীদের সংস্কৃতি পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষেরও প্রাকৃতিক সংস্কৃতিক আছে। পাশাপাশি আছে প্রজ্ঞাজাত সংস্কৃতি। মানুষের সংস্কৃতি চর্চার পেছনে জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিও ক্রিয়াশীল। একটা নীতি নৈতিকতাকে ধরে মানুষ সামাজিকভাবে নিরাপত্তা বলয় তৈরী করতে চায়। কারণ যেখানে অস্তিত্ব আছে সেখানে অস্তি্ত্বের সংকট আছে। সকল প্রকার প্রাণী, মানুষসহ, অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। মানুষ মাথা খাটিয়ে সংকট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করে। অন্য প্রাণীরা মানুষের মতো মাথা খাটাতে পারে না।শেষ রক্ষা কারো হয় না। তবু মানুষ একটা গড়পড়তা জীবনকালের হিসাব করে। ওই জীবনকালটুকু নিরুপদ্রব রাখার জন্য মানুষকে মাথা ঘামাতে হয়। এইজন্য মানুষ ঘরের আশ্রয় নেয়, সমাজ সংসার বানায়, দেশ রাষ্ট্র বানায়। এতেও সমস্যা দেখা দেয়। পক্ষ বিপক্ষের খেলা শুরু হয়। তখন ভারসাম্য রক্ষা জরুরী হয়ে পড়ে। ব্যাক্তিকে সমবায়ের আশ্রয় নিতে হয়। সমাজকে সংঘটিত হয়। দেশকেও অন্যান্য দেশের সাথে মিলিত প্রয়াস নিতে হয়। বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রগুলো এখন কোন না কোন ভাবে সমবায় বদ্ধ নইলে সুপার পাওয়ারগুলো গিলে খাবে। বিশ্বায়নের ফর্মুলা দেখিয়ে যতই বিশ্বগ্রামের কথা বলা হোক না কেন, সুপার পাওয়াগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

২.
সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে হলে একজন মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আমরা সবাই জানি, মৌলিক চাহিদাগুলো হলো, খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিতসা।একটি জাতির, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষ যদি এই মৌলিক চাহিদা সংকটে থাকে, তাহলে ওই জাতির প্রধান সংকটই হলো ঐ পাঁচটি মৌলিক চাহিদার সংকট।আমাদের দেশটি জন্মের পর থেকেই এই সংকটে জর্জরিত। দুঃখজনক ও ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয় হলো এই, সেই জন্মলগ্ন থেকেই যারা বিদ্যায় বুদ্ধিতে অর্থে বিত্তে সামর্থবান, যারা শাসন করেছেন, যারা জাতির বিবেকের আসনে অধিষ্ঠিত, তারা এই জাতির প্রধান সংকট দূরীকরণে ব্যর্থ হয়েছেন। পাঁচটি মৌলিক সমস্যার একটিরও নিশ্চয়তা অর্জন সম্ভব হয় নি। কারো কারো ব্যাক্তিক প্রয়াস কিংবা দলীয় প্রচেষ্টা কিছু কিছু ক্ষেত্রে যত্সামান্য অগ্রগতি দিয়েছে মাত্র। কিন্তু জাতীয় সংকটের সামনে সে সব সাফল্য উল্লেখযোগ্য হতে পারে না। কেননা অধিকাংশ মানুষ সংকট কবলিত।দলীয় সংকীর্ণতা, কূপমন্ডুকতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, স্বার্থান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এতোটাই প্রবল যে, আমরা আজো জাতীয় সমস্যা, জাতীয় সংকট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না।
আমাদের রাজনীতিকেরা বছরের পর বছর ধরে কিছু ইস্যু জিইয়ে রাখছেন উদ্দেশ্যমুলকভাবে। যার ফলে জাতি বহুধা বিভক্ত। জাতির পিতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, স্বাধীনতার ঘোষক, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, গণতন্ত্র না সমাজতন্ত্র না অন্য কিছু, ইত্যাকার বিষয়গুলোর ব্যাপারে এই সংকটাপন্ন জাতি কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না? কেন গরীব মানুষগুলোকে বছরের পর বছর ধরে খেলনার পুতুলের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে? কেন তাদের ভোট নিয়ে তাদেরকে ঠকানো হয়? কেন শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখা হলো না বিগত বছরগুলোতে? কেন তরুণদের বেকারত্ব দূরিকরণে ঐকমত্য হয় না? দেশের সূর্য সন্তানেরা অন্যদেশে গিয়ে অন্যদেশকে আলোকিত করছে। দেশে কেন তাদের মুল্য নাই?কেন জামায়াত নেতারা আজ মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযম, নিজামী মুজাহিদদের ভূমিকা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো। ধর্ম রক্ষার জন্য তার উদ্ভট স্বপ্নে বিভোর ছিলো। এখন তারা তাদের নিজস্ব ইসলামী ব্যাখ্যা দিয়ে কেনো জাতীয়তার প্রসঙগটিকে ঘোলাটে করেন। ১৯৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনেক ভুল ছিলো। তাই বলে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নাই। কেন জাতির পিতার কথা উঠলেই ইসলামী জাতীয়তাকে সামনে নিয়ে আসা হবে? (ইসলামী?দের দ্বারা)। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের জাতীয়তা সারা বিশ্বে একটি স্বীকৃত বাস্তবতা। ধমীয় জাতীয়তা তো আছেই তার জায়গাতে। প্রবাসে দুই জাতীয়তার পরিচয় দিতে হয়। এক ধমীয়,দুই দেশীয়। ভাষাভিত্তিক ও ভৌগলিক জাতীয়তার শত দূর্বলতা থাকা সত্তেও দেশভিত্তিক জাতীয়তাকে মেনে নিতেই হবে। নইলে দেশপ্রেমের প্রশ্ন আসবেই।
ইতিহাস তো ভরে আছে ইসলামি(?) রাজনীতির পতাকাবাহীদের দ্বারা ছড়ানো ঘৃণা আর বিদ্বেষে। সেই টু নেশন থিওরীর পক্ষে উপমহাদেশের ততকালিন বাঘা বাঘা মাওলানারা একমত হতে পারেন নি। ভারতের দেওবন্দকেন্দ্রিক বেশুমার মাওলানারা টু নেশন থিওরীর বিরোধিতা করেছিলেন। দুই পক্ষের কাছেই কোরআন হাদিস ইজমা কিয়াসের দলিল। তবু কেন এই বিদ্বেষ রক্তপাতের ধারাবাহিকতা? আমার বুঝে আসে না খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কার ইতিহাস কেন এতো রক্তাক্ত? সেখানে কি 'হক' আর 'বাতিল'র লড়াই ছিলো? ওখানে কারা সত্যের পতাকাবাহী আর কারা মিথ্যার পতাকাবাহী ছিলেন? সাহাবায়ে কেরামের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট তা কোরআনে বলা হয়েছে। ( মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, ওয়াল্লাজিনা মায়াহু.........)(ব্যাপারগুলো কেউ বুঝিয়ে দিলে উপকৃত হই।)ইয়েমেন থেকে উত্তরদিকে সিরিয়া আর পশ্চিমদিকে আটলান্টিকের পূর্বপারের দেশ মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত আরবীভাষীদের বিশাল ভূখন্ড অনেকগুলো রাষ্ট্রে বিভক্ত। খুব কাছ থেকে দেখছি, এই বিভিন্ন রাস্ট্রের আরবীভাষীদের নিজস্ব দেশীয় মায়াটান খুব শক্ত। তাদের কাছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার গুরুত্বের চাইতে দেশভিত্তিক জাতীয়তার গুরুত্ব বেশি। ওখানেও 'আবু আল ওয়াতান' বা জাতির পিতারা আছেন।
যাক্ অপরদিকে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হর হামেশা যারা সরব, তাদের ছায়ায় ধর্মবিরোধী কিছু চরমপন্থী লোক কেন আশ্রয় পায়? অতি ধার্মিকতা আর তীব্র ধর্ম বিরোধিতা একই মুদ্রার এপিট ওপিট। এই দু'পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অনিবার্য। বাঙালি সংস্কৃতির মূলে আছে মরমী ভাবধারা, যা মোটেই ধর্ম বিরোধী নয়। আর নাস্তিকতা হলো আলোচনার কেন্দ্রে আসার বেইসলেস আস্ফালন। কেননা 'হিউম্যান জিনস আর কনজেনিটেলি বিলিভারস'। আর নাস্তিকতার সাথে বাঙালির শিকড়ের কোন সম্পর্ক নেই। তবে কেন ওরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের মায়াবী আদরে লালিত হবে? ব্যাক্তি ধর্মহীন থাকতে চায় থাকুক। ব্যাক্তি অতি ধার্মিক হতে চায় হোক। ওরা রাজনীতিতে আসলেই সমস্যা। অন্যের উপর তাদের দর্শন, তাদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জোর জবরদস্তি শান্তি বিনষ্ট করবেই।কোরআন একটি মাল্টিলেয়ার্ড মিনিংফুল ঐশি গ্রন্থ। বহুমাত্রিক এর ব্যাঞ্জনা। এই গ্রন্থের শাব্দিক অর্থ নিয়ে কাউকাউ করার কোন মানে হয় না।
ধর্ম বিদ্বেষ মানে সালাতে মগ্ন মানুষটিকে ধাক্কা মারা; ধর্ম বিদ্বেষ মানে শ্রীকৃষ্ণের বন্দনায় বাধ সাধা; ধর্ম বিদ্বেষ মানে 'জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'এর ভেতর ডুবে থাকা সুবোধ মানুষটিকে আঘাত করা; ধর্ম বিদ্বেষ মানে রবিবাসরীয় চার্চের সারিতে ঢিল মারা; ধর্ম বিদ্বেষ মানে মহাবৈশ্বিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিষোদগার। ধর্ম বিদ্বেষ মানে একটা বিশৃঙ্খলা সৃস্টি করা।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু জাতীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে আন্তরিক না- হওয়া কি আমাদের মূর্খতা আমাদের কূপমন্ডুকতা নয়?বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে। আর আমাদের সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে চুরি চুরি চুরি এবং রাজনীতি। অর্থনীতির একটা কথা আছে- যেখানে মানুষ আছে, সেখানে বাজার আছে, সেখানে অফুরান সম্ভাবনা আছে, সেখানে অর্থ বিত্তের সম্ভাবনা আছে।বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের জনসংখ্যা আট দশ পনর বিশ তিরিশ মিলিয়ন। ওরা এই জনসম্পদ নিয়েই সমৃদ্ধ। আর আমাদের জনসংখ্যা এক শ' ছাব্বিশ মিলিয়ন প্রায়। তবু আমরা দারিদ্রতার অতলে অন্তরীণ!!

No comments: