Pages

Tuesday, November 6, 2007

ভালোবাসা কিংবা ভেতরে বাহিরে মূর্ত বহু বর্ণিল মায়া


ভালোবাসা কি?
মানবজাতির প্রজ্ঞার সামনে এ এক জটিল প্রশ্ন। যথাযথ সংগায়ন কঠিন। কারণ বহুমূখী এর ব্যাঞ্জনা।
ভালোবাসার প্রকারভেদের ভেতরেই কি এর সংগা লুকিয়ে আছে?
মূল কথনে যাবার আগে কিছু পংক্তি তুলে ধরি
এ জীবনের আঁধার পথে
পাও যদি কেউ এমন প্রাণ
যে তোমাকেই ভালোবাসে
আপন হৃদয় করবে দান।
প্রাণ খুলে তায় ভালোবাসো
জড়িয়ে ধরো বক্ষে থাকে
ত্যাগ করো সব তার খাতিরে
তুচ্ছ করো জগতটাকে।
--ওমর খৈয়াম

কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে
তাহাতে নাই দুখ
তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার
গলায় পড়িতে সুখ
--চন্ডীদাস

চাও নাহি চাও ডাকো নাহি ডাকো
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো
যাব সাথে সাথে র'ব পায় পায় র'ব গায় গায় মিশি
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু
বহু পাত্রে ঢেলে পি'ব সেই প্রেম
সে সবার লোহু
--কাজী নজরুল ইসলাম

ব্যাস, আর উদ্ধৃতি না। এবার ভালোবাসার প্রকারভেদের ভেতরে গিয়ে ঢুকি। উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোতে মূলত নারী পুরুষের চিরন্তন প্রেম ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা অগণন প্রকারে মূর্ত।
১.
সম্পর্কের ভেতরে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। সম্পর্ক স্থান কাল পাত্রকে কেন্দ্র করেও রচিত হতে পারে। একট স্থানের জন্য, একটা পাত্রের জন্য, একটা নির্দিস্ট সময়ের জন্য ভালোবাসাবোধ তৈরী হতে পারে। স্থানটি পাত্রটি সময়টি হারিয়ে গেলে কিংবা হাতছাড়া হলে বেদনাপ্লুত হতে হয়; ফিরে পেতে মন আকুল হয়।
২.
পিতামাতার ভালোবাসা, ভাইবোনের ভালোবাসা, স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা, আত্মীয় কিংবা বন্ধুর ভালোবাসা তো আছেই। সমাজ সংসারের ভারসাম্য রক্ষায় এইসব ভালোবাসা গুরুত্ববহ। এই ক্ষেত্রে দায়বোধের সমান্তরালে ভালোবাসাবোধ সক্রিয় থাকলে মায়াময় একটা আবহ তৈরী হয়। কখনো দেখা যায়, রক্তের সম্পর্কের নিকটজনের চেয়ে দূরের বন্ধু বান্ধবী অনেক বেশি আপন হয়ে যায়।
৩.
আবহমান সমাজ সভ্যতার পরতে পরতে যৌক্তিক বিচার বিন্যাস কার্যকর হয়, সফল হয়, ভালোবাসার স্পর্শে। মায়াহীন সিদ্ধান্ত আর যান্ত্রিক উত্পাদন একই অর্থ বহন করে। যান্ত্রিকতা প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কিন্তু অনিন্দ্য আবেশে জড়াতে পারে না।
৪.
ভালোবাসা এক প্রকারের শক্তি। এটোমিক প্রচন্ডতাও থেমে যেতে পারে পারে ভালোবাসার যথাযথ ব্যবহারে। ভালোবাসার শক্তি সমৃদ্ধি আনে, সুস্থতা আনে, শুদ্ধতা আনে। ভালোবাসাথেরাপি রোগ নিধনও করতে পারে। কেননা কখনো কষ্টের কান্তার পেরিয়ে অনুপম অনুভূতিও এনে দেয় ভালোবাসা।
৫.
নারী পুরুষের দেহের কামনায়ও ভালোবাসার মিশ্রণ আছে। এখানে পারস্পরিক প্রয়োজন পূরণের তাগিদের ভেতরে যদি ভালোবাসা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে মধুর মিলন হবার সম্ভাবনা শুণ্য। সেক্ষেত্রে ওষ্ঠাধরের চুম্বন যৌনতার একটা দায়সারা গোছের শারীরিক অনুভূতি দেবে কিন্তু সাগরের উত্থাল উর্মির মতো দুই দেহের রক্ত কণিকাদের উদ্বাহু নৃত্য মন প্রাণ আকুল করবে না; খুব সহজ স্বাভাবিক মহুয়া মাতাল বোধের কুঞ্জে প্রবেশ করবে না দুই প্রাণ দুই দেহ।যৌনতার সাথে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক আছে মাত্র। যৌনতার তৃষ্ণাই ভালোবাসা না। ধর্ষণে জৈবিক তৃষ্ণা মিটে ধর্ষকের শুধু। ওখানে মনের ছোঁয়া থাকে না। 'তব অঙ্গ লাগি মোর অঙ্গ কাঁদে'-এখানে ভালোবাসা আর যৌনতার তৃষ্ণা একাকার। ভালোবাসামাখা যৌনতার অনুভূতি নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর অতুলনীয় অনুভবের জগতে সন্তরণ করায়।
৬.
কখনো মেধা কখনো দেহের সৌষ্ঠব কখনো আচরণের শৈল্পিক প্রকাশ ভালোবাসাবোধ সৃষ্টি করতে পারে। কবিকে শিল্পীকে লেখককে দার্শনিককে বিজ্ঞানীকে চিত্রকরকে কিংবা বিশেষ আলোকিত মানব মানবীকে আমরা ভালোবাসি কেন? সে ভালোবাসাটাও কি কম গভীর? প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুতে শোকাহত হতে হয় নিদারুণ। কোন বড় মাপের মেধাবী মানব মানবীর জীবনাবসানে লাখো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, অশ্রুর ধারা নামে, নির্বাক হতে হয়, স্বাভাবিক জীবন যাপন এলোমেলো হয়ে যায়। শুধুমাত্র লেখা পড়ে পাঠক মহলে সংশ্লিষ্ট লেখকের জন্য মায়া অনুভব হয়। হয়তো জীবতকালে কখনো ওই লেখককে সরজমিনে এক নজর দেখার সুযোগ হয় নি। তবু তাঁর সৃষ্টি-কর্ম পাঠকের মন ছুঁয়েছে বলেই ভালোবাসাবোধ তৈরী হয়।
৭.
কখনো মনে হয় ভালোবাসা আর সুন্দর একই মুদ্রার এপিট ওপিট। মনে হয় স্পেসটাইম বা টাইমস্পেস এর মতো। যাহা সময় তাহা স্থান, যাহা স্থান তাহাই সময়। সুন্দর মিলিয়ন প্রকার। ভালোবাসাও মিলিয়ন প্রকার। সুন্দর আকর্ষণ করে। ভালোবাসাও আকর্ষণ করে। দূর বহুদূর হতে অনুভূতি ছুটে আসে আর যায় মনের অলিন্দে। ভালোবাসা সুবোধ দেয়, ইতিবাচকতা দেয়। সুন্দরও সুবোধ দেয়, ইতিবাচকতা দেয়। ভালোবাসা প্রাণজ দোলা দেয়; সুন্দরও প্রাণজ দোলা দেয়।
৮.
ভ্রাম্যমান মানুষের মনের সাথে ভালোবাসাও ঘুরে বেড়ায়। কখন কোথায় যায় ঠিক নাই। স্থির থাকে না। ভালোবাসাও কমে বাড়ে। বিকৃত হয়,বিভাজিত হয়, কৃত্রিম হয়। ভালোবাসাকে ব্যবহার করে মানুষ অপকর্মও করে। যে ভালোবাসায় সহজ স্বাভাবিকতা নেই, সেখানে মধুরতাও নেই। ভড়ং দিয়ে ভালোবাসাকে অলংকৃত করা যায় না। ভালোবাসাকে চাপিয়ে দেয়া যায় না। জোরপূর্বক ভালোবাসাও যায় না।ভালোবাসা মানুষকে নিদারুণ অসহায় বানায়। ভালোবাসার গহনে সাঁতার কাটতে কাটতে দিকভ্রান্তিও আসে। পাপ পূণ্যের ভেদাভেদ ভূলে যায়। জাগতিক অনেক চেতনা চাপা পড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আচরণ হয়ে ওঠে শিশুসুলভ।
৯.
ভালোবাসা সৃস্টিশীল। ভালোবাসার সম্মিলিত পরশে ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়, অনুপ্রাণীত হয়। ভালোবাসার প্রাখর্য্য বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়। প্রিয়তমার/প্রিয়তমের প্রতীক্ষার প্রহরে কন্ঠের কারুকাজে সুন্দরম শব্দ বিন্যাসে গীতল মাধুরী ছড়িয়ে ভালোবাসা প্রকাশিত হয়। ভালোবাসা সমুদ্রের ঢেউ হয়, ভালোবাসা ঝর্ণাধারা হয়, ভালোবাসা স্রোতস্বীনি নদী হয়, ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে আকাশ ও চোখের গহন থেকে। ভালোবাসা সবুজ ঘাসের গালিছায় জোছনাশোভিত হয়। ভালোবাসার পরশে মায়ের কোলের প্রানবন্ত ফুলের মতো শিশুটি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
১০.
বিস্ময়কর সত্য হলো এই, ভালোবাসার জন্য মানুষ ধ্বংসের খেলায় মাতে, রাজনীতি করে, কূটনীতি করে, যুদ্ধ করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। জগতের জাতিতে জাতিতে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পেছনে নিজ নিজ পক্ষের জন্য ভালোবাসা ক্রিয়াশীল। যদিও এই প্রকারের ভালোবাসায় যথেষ্ট মূর্খতা অন্ধতা বিদ্যমান। নিজ নিজ ধর্মের ভালোবাসার ডাকে অন্ধ মানুষ ধর্মযুদ্ধেও লিপ্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইগুলো সত্যিই বেদনাদায়ক। অথচ প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোর মূল বাণীতে মানবজাতির জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবু অবস্থানগত বাধ্যতা নির্মমতা নিয়ে আসে। মানুষ নিজকে, নিজেদেরকে ভালোবেসে অন্যের ভালোবাসাকে আঘাত করে।
১১.
পশু পাখির ভালোবাসা দেখেছেন? আমি দেখেছি, চৈত্রের নিস্তব্দ দুপুরে অথবা শীতার্ত সন্ধ্যায় গায়ে গায়ে লেগে শিরীষের নিভৃত ডালে বসে আছে দু'টি ঘুঘু। আমি দেখেছি, গলায় গলা জড়িয়ে প্রশান্ত ছিলের পারে বসে থাকে হংস আর হংসিনী। মায়ের উষ্ণ ডানার অন্দরে বসে শুধু চোখ মুখ বের করে তাকিয়েছে মুরগী ছানারা। আমি বলেছি, 'বাচ্চারা মুখ লুকাও নইলে চিল নেউল দেখে ফেলবে।' সাথে সাথে ওরা ঢুকে গেছে মমতার অন্তঃপুরে। আমি দেখেছি, পরস্পরের কোলে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়েছে কুকুর কুকুরী।
১২.
ভালোবাসা আবেগজাত এক অদৃশ্য চেতনা। বাংলার ভাববাদী দর্শনের ভেতরে শুধু প্রেম আর প্রেম। তাই শত দুঃখ কষ্টে থেকেও বাঙালি মরমী সংগীতের সুধা পান করে করে অনিন্দ্য আনন্দে ভাসে। মরমী ভাবনায় নারী পুরুষের দেহজ প্রেমের রূপকে প্রকাশ পায় অনন্তের প্রেম। রাধা-কৃষ্ণ, লাইলি-মজনু, শিরী-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট ইত্যাকার সবাই প্রেম প্রকাশের উপলক্ষ। ওরা প্রতীক। ওরা উপমা। ওরা দৃষ্টান্ত। বিচ্ছেদ বিরহের গান গজলগুলো সমর্পিত আত্মার আহাজারি; পরমাত্মার বিচ্ছেদে জীবাত্মার বেদনাপ্লুত ক্রন্দন।মরমি সাধকেরা প্রেমাগুনে পুড়ে আংগারা হন; প্রেম দরিয়ায় তরী ভাসান; হৃদপিঞ্জরের পাখিকে দর্শনের চেষ্টা করেন।আর উজান গাঙ্গের নাইয়া মানে শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ছুটে চলা প্রেমিক প্রেমিকা। এই প্রেমের হিসাব বড় আজব; খুব চমৎকার। জাগতিক অংকের হিসাবটা হলো, এক+এক=দুই। কিন্তু এই প্রেমের হিসাবে ১+১=১ হতে হয়। ব্যাপারটি পুরোপুরি সাইকোলজিক্যাল। ব্যাপারটি মেন্টাল; ব্যাপারটি অদৃশ্যের; ব্যাপারটি মনের; ব্যাপারটি অরূপের। মেটেরিয়েলটা, বস্তুটা, দেহটা মাধ্যম মাত্র। আমার মনে হয়, মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টিই প্রতীক।এই জগতমন্ডল প্রতীকায়িত। এই জগতে মায়া আছে, মায়ার বন্ধন আছে, আবার বিচ্ছেদও আছে। বিচ্ছেদ মায়ার অনুভূতিকে শাণিত করে। আবার মায়া জীবনকে উজ্জীবিতও করে, অনুপ্রাণিত করে। মায়া সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ করে আদি থেকে অন্তের দিকে ছুটে চলেছে নিরন্তর।

প্রাসঙ্গিক দ্রস্টব্যঃ
জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়তে লড়তে পর্যুদস্থ পথিক বলেন, 'ভালোবাসা-টাসা কিছু নাই রে ভাই! শুধু প্রয়োজনে দিন যাপন আর কাজ করে যাওয়া।' কথাটা অভিমান থেকে বের হয়। তিনিও তার নিজের জীবনকে ভালোবেসে এবং তার জীবনের সাথে জড়িত অন্যান্য ভালোবাসার প্রসঙ্গগুলোকে রক্ষার তাগিদেই জীবনের ঘানি টানতে থাকেন।